ব্রিজ থেকে ২০ ফুট নিচে পানিতে দুধের শিশুকে ফেলে দিলেন মা। ফেলে দেয়ার পর শিশুটি পানিতে ভাসতে থাকে। তবে রাখে আল্লাহ মারে কে? পরে পথচারী এবং এলাকাবাসী শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে।
শিশুটি এখন স্থানীয় রফিকুল ইমলাম এবং এলিনা দম্পতির কাছে রয়েছে। এলিনা শিশুটিকে তার বুকের দুধও পান করিয়েছেন। শিশুটি এখন সুস্থ আছে।
শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের কাশিমবাজার এলাকা এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকে শিশুটির মা জমিলা বেগম পালিয়ে নিজ বাড়িতে চলে গেছেন।
জমিলা বেগমের দাবি, একবছর আগে দুই মাসের সন্তান জাহিদকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি রংপুর থেকে বিতাড়িত হন তিনি। পরে উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের পূর্বকেদার গ্রামের দরিদ্র বাবা জয়নাল মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। দিনমুজুর বাবার বাড়িতে অভাব-অনটন থাকায় সন্তানের ভরণপোষণ নিয়ে প্রায় দ্বন্দ্ব হতো। সন্তানের খাবার এবং খরচ চালাতে মাঝে মধ্যে তাকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো। এসব কারণেই সন্তানকে পানিতে ফেলে দেয়ার চিন্তা আসে তার মাথায়।
জমিলা বেগমের বাবা জয়নাল মিয়া বলেন, ‘সকালে আমি ও আমার ছেলে মাটি কাটতে যাই। মাটি কাটার জায়গা থেকে কিছুটা দূরে মানুষের কোলাহল শুনে জানতে পারি, আমার মেয়ে জমিলা তার ছেলে জাহিদকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। কী কারণে এরকম কাজ করল তা আমি জানি না।’
প্রতিবেশীরা জানান, দুই বছর আগে রংপুরের মর্ডান মোড়ের ভর্ত কবিরাজের ছেলে হাফিজুরের সঙ্গে জমিলার বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের এক বছর পরেই দুই মাসের কোলের শিশুকে নিয়ে সংসার ভেঙে যায়। জাহিদকে নিয়ে তার বাড়িতে ফিরে আসেন। এদিকে তিন সন্তান নিয়ে বড় মেয়ে জরিনা সংসারে ফিরে এসে মাথার বোঝা হয়ে দাঁড়াই জয়নাল মিয়ার। সবমিলিয়ে ৯ সদস্যর পরিবারে ভরণপোষণ কঠিন হয়ে পড়ে। দিনমজুরি করে এই বিশাল সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
জমিলার মা জবেদা বেগম জানান, প্রায় জমিলার সন্তান নিয়ে পরিবারে অশান্তি লেগেই থাকতো। তার খরচ চালাতে চাইতেন না জমিলার বাবা।
জমিলার বৃদ্ধা নানি সুফিয়া বেওয়া জানান, তার ভিক্ষাবৃত্তির চাল দিয়ে মাঝেমধ্যে জমিলার সন্তানের খরচ চলত। তবে জমিলা তার সন্তানের জন্য অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেস। এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে সন্তানকে পানিতে ফেলে দিয়েছেন।
শুক্রবার জমিলা দুই কেজি চাল সবার আড়ালে বিক্রি করে শিশুর জন্য খাবার ও তেল সাবান কিনে আনলে বাবা জয়নাল রাগান্বিত হয় এবং তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। মনের দুঃখে অবুঝ শিশুকে নিয়ে হতাশ জমিলা বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কাশিম বাজার সংলগ্ন একটি ব্রিজের কাছে যান। পরে শিশু সন্তানকে পানিতে ফেলে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল হোসেন সন্তোষ জানান, সকাল নয়টার দিকে বাড়ি থেকে তিনি ওই পথে বাজারে যাচ্ছিলেন। এসময় ব্রিজটির ওপরে উঠলে এক নারীকে কিছু পানিতে ফেলতে দেখেন। কিছু পড়ার শব্দ শুনে নিচে তাকিয়ে দেখে একটি শিশু পানিতে ভাসছে এবং হাত-পা নাড়াচ্ছে। এটা দেখে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। তার চিৎকারে স্থানীয় ফরিদুল ইসলাম এবং একজন পথচারী এগিয়ে আসেন। ব্রিজ থেকে নেমে পানি সাঁতরিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন তারা।
তিনি আরও জানান, শিশুটিকে উদ্ধার করতে তাদের ২০ মিনিট সময় লেগে যায়। এতক্ষণ শিশুটি পানিতে ভাসতে থাকে। উদ্ধারের পর আগুন জ্বালিয়ে তাপ দিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়। এসময় ব্রিজের পাশের বাড়ির রফিকুল ও এলিনা বেগম দম্পতি শিশুটিকে হেফাজতে নেন এবং সেবা-যত্ন করেন।
এলিনা বেগম বলেন, শিশুটিকে তার বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে। শিশুটিকে তিনি লালন-পালন করতে চান।
বলদিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বাবলু খান জানান, মেয়েটির মানসিক সমস্যা আছে। মানসিক সমস্যার কারণে সে তার শিশুকে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
বলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান জানান, জমিলা একাধিক স্বামী পরিত্যক্তা। সর্বশেষ স্বামীর কাছে পরিত্যক্তা হওয়ার পর বাবার বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু বাবা অত্যন্ত দরিদ্র হওয়ায় জমিলার সন্তানের ভরণপোষণ দিতে পারেন না। তাই হয়তোবা জমিলা তার শিশুর খাদ্যের জোগান দিতে না পারায় পানিতে ফেলে দিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, শিশুটি আপাতত রফিকুল ও এলিনা বেগম দম্পতির কাছে রয়েছে। তাকে তার মায়ের কাছে ফেরত দেয়া হবে।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানতে পেরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়েছি। তাকে সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলেছি। আমরা ওই মহিলাকে সর্বাত্মক সহায়তা দেব।’