ক্ষমতাসীন দলের আওয়ামী লীগের ১৯টি সম্পাদকীয় উপকমিটি রয়েছে। সেই ১৯টি উপকমিটির একটি ধর্মবিষয়ক উপকমিটি। দেশের কওমি ও আলিয়া মাদরাসার কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামাদের নিয়ে ২০১৭ সালে ক্ষমতাসীন দলের এ উপকমিটি গঠিত হয়।
ধর্ম উপকমিটির চেয়ারম্যান করা হয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য খন্দকার গোলাম মাওলা নকশবন্দিকে। আর সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ধর্ম সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ।
খন্দকার গোলাম মাওলা নকশবন্দি ও শেখ আব্দুল্লাহ’র আকিদাগত মতের মিল না হওয়ায় দুটি পৃথক পৃথক কমিটি করেন তারা। দুই কমিটিতেই রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামি চিন্তাবিদগ।
২১তম জাতীয় সম্মেলনে ধর্ম সম্পাদকের পদ থেকে বাদ পড়েন শেখ আব্দুল্লাহ। তিনি কওমি অঙ্গনে পরিচিত ছিলেন। ছিলেন কওমি মাদরাসার ছাত্রও। গত জুন মাসে ১৩ তারিখে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন শেখ আব্দুল্লাহ।
দ্বিতীয় মেয়াদেও ধর্ম উপকমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান সুন্নীপন্থি হিসেবে পরিচিত খন্দকার গোলাম মাওলা নকশবন্দি। তবে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের প্রায় ১ বছর শূণ্য ছিলো ধর্ম সম্পাদকের পদ। এরপর সেই শূন্য পদে মনোনীত করা হয় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফাকে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতায় মাঠে নেমেছে দেশের কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ভাস্কর্যকে মূর্তির সঙ্গে তুলনা করে তা নির্মাণ ‘হারাম’ বলেও ফতোয়া দিচ্ছেন দেশে শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামাদের একটি অংশ। কওমিপন্থি আলেমদের মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সুন্নীপন্থি আলেমরাও। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেছে কওমি মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী। ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশের চলমান অস্থিরতা ও সংকট নিরসনের জন্য সরকারপ্রধানের সঙ্গেও বসতে চান আলেমদের একটি অংশ।
তবে ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে যখন গরম দেশের ইসলামি রাজনৈতিক অঙ্গন তখন এই ইস্যুতে ‘টু শব্দও করেননি’ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ধর্ম উপকমিটির আলেম-উলামারা। অথচ সারাদেশ থেকে মুজিবীয় আদর্শিক পরিবার থেকে বাছাই করে দেশ, জাতি ও দলের স্বার্থে ধর্ম উপকমিটিতে আলেম-ওলামাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
দলের এই পরিস্থিতিতে একটি শব্দও খরচ করেননি উপকমিটির সদস্য আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ। তাহলে ধর্ম উপকমিটির আলেম-উলামাদের কাজ কী? তাদের কাজ কি রাষ্ট্রীয় ইফতার মাহফিলে অংশ নেয়া; বিশেষ বিশেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত হওয়ার মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ তাদের ভূমিকা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধর্ম উপকমিটির সদস্যদের অনেকেই নিজেকে পরিচয় দিয়ে সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন দফতর থেকে নানা সুবিধা নিয়ে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বির্তকের ঝড় উঠেছে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য ও ইসলামি চিন্তাবিদদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে । বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ইস্যুতে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে তাদের অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করেন ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য ও জামেয়া দারুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিষয়ে প্রশ্ন শুনেই মিটিংয়ে থাকার ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউসুফ।
ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য শায়খুল হাদীস মাওলানা ওয়াহীদুযযামান। তিনি জামিয়া আরাবিয়া আশরাফিয়া এতিমখানার প্রিন্সিপাল। আলেমদের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম ফতোয়ার দিয়েছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধর্মের বিষয় আলেমরা ভালো জানেন। আলেমরা যা বলবে তা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করবো। তবে শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতার বিষয়টি আমরা গবেষণা করছি। আর যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাদের আমরা নজরে রাখছি।’
ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য, শায়খুল হাদিস মাদরাতুল রহমানের শিক্ষক মাওলানা তাজুল ইসলাম পরে কথা বলবে বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রসঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে চান না হাফেজ মাওলানা মাজহারুল ইসলাম। তিনিও ধর্ম উপকমিটির সাবেক সদস্য এবং আম্বরশাহী জামে মসজিদের খতিব। আওয়ামী লীগের ধর্ম সম্পাদক হওয়ার জন্য লবিং করেছিলেন এই মাওলানা। তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্য ইস্যুতে আমি সরাসরি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’ এরপরই লাইনটি কেটে দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে নীবর থাকা এই সমস্ত আলেম উলামা ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ পুনরায় ধর্ম উপকমিটিতে জায়গা পেতে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ইস্যুতে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোনে কথা বলতে চাননি সুন্নিপন্থি বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ধর্ম উপকমিটির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মাওলা নকশবন্দিও।
তবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে শুরু থেকেই মাঠে ছিলো আওয়ামী লীগ থেকে স্বীকৃতি না পাওয়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ। ওলামা লীগ নেতারা বলেছে, ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা জ্ঞানের স্বল্পতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। ভাস্কর্য হচ্ছে একটি শিল্প যা নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আর মূর্তি বানানো হয় ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে উপাসনা করার জন্য। ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধীরা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, রাজনৈতিক স্বার্থেই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে। ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয় এ বিষয়ে ওলামা লীগের নেতারা রাজধানীতে বিভিন্ন সময় লিফলেট বিতরণ করেছেন বললেন?