রবিবার, ০৪ জুন ২০২৩, ১০:৪৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
উপকারভোগীদের কৃষি উপকরণ বিতরণ করলেন এনজিও সংস্থা “মুক্তি “ পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিবন্ধীকে ব্যাপক মারধরের অভিযোগ! দেশে ৪ কোটি মানুষের চলছে দুর্দিন,ঋণ করেই চলছে ৭৪ভাগ পরিবার কোস্টগার্ডের ধাওয়ায় ৭ লাখ ইয়াবা পানিতে ফেলে পালাল পাচারকারীরা ‘ইশ্-মার্ট বাংলাদেশ’ প্রভাষক শাহীন সরওয়ার টানটান উত্তেজনায় শেষ হল শেখ রাসেল গোল্ডকাপ;বিজয়ীদের পুরষ্কার তুলে দেন অতিথিগণ টেকনাফে মুক্তি কক্সবাজার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্পের উপকারভোগীদের মধ্যে প্রশিক্ষণ পরবর্তী নগদ অর্থ সহায়তা বিতরণ টেকনাফে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন অভাবনীয় সফলতায় মেম্বার এনামের প্রতিষ্ঠিত বালিকা মাদ্রাসা টেকনাফে “অক্সফাম” কর্তৃক ভাউচার প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ

মাদক নির্মূলে আইনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো উচিত

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১২ মার্চ, ২০২২
  • ৩৪৪ বার পঠিত
মাদকাসক্ত একটি ভয়ানক ব্যাধি। যাহা তিলে তিলে সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেয়।ততক্ষণ পর্যন্ত  একটি জাতি অগ্রসর হতে পারেনা, যতক্ষন না জাতির মধ্যে সুস্থ ধারার বিকাশ  ঘটে।
মাদক ব্যাপক বিস্তারের কারণে আজকে জাতি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। আজকে মাদকের ব্যাবহার দেশের সীমান্ত পেরিয়ে আজকে পৌঁছে গেছে সমগ্র বিশ্বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় সাত কোটি সত্তর লাখ মানুষ মাদকের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কঠিন রোগে ভুগছে। ওই সংস্থার তথ্যানুসারে, বিশ্বের সব রোগের প্রায় চার শতাংশ মদপানজনিত। এ কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর হাজার বিলিয়ন ডলার অপচয় হচ্ছে।
যাহা সমগ্র মানব জাতির জন্য এক অভিশপ্ত বার্তা। কারণ মাদকে অতিরিক্তি ব্যাবহারের  কারণে যুবসমাজ ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে , কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে । শারীরিক প্রতিবন্ধীও হয়ে পড়ছে কেউ কেউ , যৌনক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে , জীবনের প্রতি ঘৃণা ও উদাসীন মানসিকতা তৈরি হচ্ছে , সর্বোপরি মাদকাসক্তির ফলে যুবকরা ক্রমেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হচ্ছে। যার ফলে আমরা সমগ্র পৃথিবীতে বেড়েছে ডাকাতি, খুন, রাহাজানি সহ বেকারত্ব ও ভয়াবহ অপরাধ চক্রের সংখ্যা। এসব অপরাধ কান্ডের কারণে আজকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ দেশে অপরাধ নিমূলে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় করে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে মাদকের ব্যাবহার নতুন নয়।
মাদকের ব্যাবহার অতি প্রাচীন। ১৬০০ সালে বাংলায় ইংরেজ বণিকগণ বিট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠার পর উক্ত কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাংলার উর্বর মৃত্তিকায় আফিমের চাষ করতেন। সেই আফিম পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাপ্লাই দিত এবং অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতেন। তারা প্রাথমিক ভাবে আফিমের ব্যাবসায় সফল হওয়ার পর মাদক ব্যাবসা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিদ্রোহের পর আফিম ব্যবসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এনে প্রথম আফিম আইন প্রবর্তন এবং ১৮৭৮ সনে আফিম আইন সংশোধন করে আফিম ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর গাঁজা ও মদ থেকেও রাজস্ব আদায় শুরু হয় এবং ১৯০৯ সনে বেঙ্গল এক্সাইজ অ্যাক্ট ও বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। আফিম, মদ ও গাঁজা ছাড়াও আফিম ও কোকেন দিয়ে তৈরী বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রসার ঘটলে ১৯৩০ সনে সরকার The Dangerous Drugs Act-1930 প্রণয়ন করে। একইভাবে সরকার আফিম সেবন নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৩২ সনে The Opium Smoking Act-1932 প্রণয়ন এবং ১৯৩৯ সনে The Dangerous Drugs Rules-1939 প্রণয়ন করে। ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদের জন্য মদ পান নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫০ সনে  The Prohibtion Rules-1950  তৈরী হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সনে The Opium sales Rules-1957 প্রণীত হয়।
এরপর ষাটের দশকে বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টকে এক্সাইজ এন্ড ট্যাক্সেশন ডিপার্টমেন্ট হিসেবে নামকরণ করে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্ত করা হয়।১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৬ সনে এক্সাইজ এন্ড ট্যাক্সেশন ডিপার্টমেন্টকে পুনরায় পুনর্বিন্যাসকরণের মাধ্যমে নারকটিকস এন্ড লিকার পরিদপ্তর নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন ন্যস্ত করা হয়। ১৯৮২ সনে কোডিন মিশ্রিত কফ সিরাপ, এ্যালকোহলযুক্ত কতিপয় হেলথ টনিক, ট্যাবলেট, সিরাপ ইত্যাদির উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৪ সনে আফিম ও মৃতসঞ্জীবনী সুরা নিষিদ্ধকরণ এবং ১৯৮৭ সনে গাঁজার চাষ বন্ধ ও ১৯৮৯ সনে সমস্ত গাঁজার দোকান তুলে দেয়া হয়।১৯৮৯ সন পর্যন্ত নারকটিকস এন্ড লিকার পরিদপ্তরের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে উৎপাদিত মাদকদ্রব্য থেকে রাজস্ব আদায় করা। আশির দশকে সারা বিশ্বে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে এ সমস্যার মোকাবেলায় মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধ, মাদকের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গণসচেতনতার বিকাশ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৮৯ সনের শেষের দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ জারী করা হয়। অতঃপর ২ জানুয়ারী, ১৯৯০ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন,১৯৯০ প্রণয়ন করা হয় এবং নারকটিকস এন্ড লিকারের স্থলে একই বছর তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখ এ অধিদপ্তরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাস্ত করা হয়।
পরবর্তীতে উক্ত আইনের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সরকার ২০১৮ সালের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ নামে নতুন আইন প্রবর্তিত করেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পূর্বের চেয়ে বর্তমানে মাদকসক্তের সংখ্যা দ্বিগুন। যাহা আমাদের জন্য ভয়াবহ। কারণ এই ভাবে যদি আমরা মাদকাসক্ত দুর করতে না পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস হতে বেশিদিন লাগবেনা।
 এসব সমস্যা থেকে রেহায় পেতে দেশে বারবার নতুন আইন পাশ করে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না?  মাদক বিস্তারের মূল কারণ চিহ্নিত না করে, আইন পাশ করে সাজার হুমকি দিলে কখনো অপরাধ ধমন করা যাবেনা। কারণ আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন করলাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা অধিকাংশ আসামিদের নিম্ন আদালত কতৃক সাজা প্রদান করলেও উচ্চ আদালতে আইনের ফাকফৌকরের কারণে আসামীদেরকে আপীলে খালাস প্রদান করেন।
এসব খালাসের মূল কারণগুলো অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে,  দায়েরকৃত মামলার এজাহার ও ১৬১ ধারার জবানবন্দি ও আদালতে প্রদানকৃত সাক্ষীর জবানবন্দিতে গড়মিল, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা অনুসরণ পূর্বক জব্দ তালিকা প্রস্তুুত না করা, নিরপেক্ষ পাবলিক স্বাক্ষী কতৃক মামলায় সাক্ষ্য প্রদানে ব্যর্থতা, উদ্ধারকৃত মাদক রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা না করা সহ রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনায় খামখেয়ালির কারণে অনেক সময় মামলা দুর্বল হয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিত ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের মূলণীতি অনুসারে মাদকদ্রব্য উদ্ধার ঘটনাটি ভিত্তিহীন করে তুলে।
ফলশ্রুতিতে আসামী অনেক সময় মামলা থেকে সাক্ষ্য প্রমাণে বেকসুর খালাস পেয়ে থাকেন। এই খালাস পাওয়ার পর মাদকের সিন্ডিকেট চক্র আবার মাদক ব্যবসা করতে উদ্ভব হয়ে থাকে। কারণ পূর্বের অপরাধ থেকে আইনের ফাকফৌকরের কারণে খালাস পাওয়ার পর নতুন করে উক্ত ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও  বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদকের সর্বাত্মক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থিত। এসব দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচারের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবহার করার কারণে মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তাই আইন পাশ না করে আইনে উপযুক্ত প্রয়োগের ব্যাবস্হা করা হউক। অপরাধীরা যাতে করে আইনের ফাকফৌকর দিয়ে পার না পায় সেই ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রশিক্ষিত করতে হবে।তাছাড়াও মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যাবহার করছে।
তারা যাতে মাদক পাচার করতে না পারে সে ব্যাপারে কূটনীতিক তৎপরতা সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের উপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করা। পাশাপাশি সীমান্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আরো সতর্ক অবলম্বন করে মাদকের বিরোদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলে মাদক সমূলে উৎপাটন করা না গেলেও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
জিয়াবুল আলম
আইনজীবী
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Developed By Bangla Webs
error: Content is protected !!