ভূমিকা :
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহার বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারিত্বের বিষয় নতুন করে ভাবনার অবকাশ আছে বটে। জননিরাপত্তা ও ফৌজদারি বিচার ব্যাবস্থার অন্যতম অংশীদার বাংলাদেশ পুলিশ যখন এরূপ অপেশাদারী আচরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান প্রহরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফিল্ড অফিসার লেভেলের মেজর পদমর্যাদার একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না, তখন এই পুলিশের পেশাদারিত্বের বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নাই।
[ মেজর সিনহা হত্যা চারটি ভাবনার উদ্রেক করেছে]বর্ণিত অবস্থাধীনে চারটি বিষয় বিশেষ প্রণিধানযোগ্য এবং সেগুলো হলো নিম্নরূপঃ-
(১) মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক ব্যাবহারে পেশাদার পুলিশ পেশাদারিত্ব হারিয়ে আইন ভঙ্গের দানবে পরিণত হয়েছে।
(২) RAB এর জন্মলগ্ন থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের সূচনা হবার পর থেকে পুলিশ বিভাগ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
(৩) পুলিশ কোরোনার প্রাক্কালে যে নজিরবিহীন পেশাদারিত্ব দেখিয়েছে তা সত্ত্বেও এই ধরণের ঘটনা প্রমান করে পুলিশের মধ্যে এখনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কর্মকর্তাদের অভাব নাই।
(৪) বাংলাদেশ সরকারের স্লোগান – “মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার” – এখন নিছক তামাশার বাণীতে পরিণত হয়েছে।
সরকারের এখনই উচিত কালবিলম্ব না করে পুলিশ বাহিনীর ভিতরে থাকা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে এখনই তাঁদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
[পুলিশ ইউনিট প্রধানদের কর্তব্য ও সংশ্লিষ্ট দায় ]
(১) থানা ও ফাঁড়ি পর্যায়ে যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করা হয়, তাদের সার্ভিস বুক কিংবা এ.সি.আর গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে তাঁর পেশাদারি যোগ্যতা কতটুকু।
(২) যে সকল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তিত বিভাগীয় শৃঙ্খলা ও শাস্তি মূলক ইতিহাস আছে এবং কোন বিভাগীয় শৃঙ্খলা মূলক কার্যক্রম চলমান আছে এরূপ কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে থানা ও ফাঁড়ি পর্যায়ে দায়িত্ব দেয়া যাবে না।
(৩) যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা স্বভাবগতভাবে (Habitual) শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত তাঁদেরকে থানা ও ফাঁড়ি পর্যায়ে দায়িত্ব না দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দিতে হবে এবং একই সাথে জনগুরুত্পূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না।
(৪) প্রত্যেক জেলার কিংবা অন্য সকল পুলিশ ইউনিট প্রধান তাঁর অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তার অপকর্মের জন্য দায়ী হবেন। কেননা জেলা পুলিশ প্রধান বা অন্য পুলিশ ইউনিট প্রধান তাঁর অধীনস্ত পুলিশ ইউনিট সমূহের বদলি নিয়ন্ত্রণ করেন। কাজেই ইউনিট প্রধানগণ অবিবেচনাপ্রসূত নিয়োগের জন্য দায় এড়াতে পারে না।
(৫) প্রত্যেক জেলার কিংবা অন্য সকল পুলিশ ইউনিট প্রধান তাঁর অধস্তন পুলিশ ইউনিটে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার কার্যাবলী গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখবেন এবং প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য নিয়মিত পর্যালোচনা করবেন করতঃ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
(৬) প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত Judicial Conference এ পুলিশ কার্যক্রম সংশোধন ও সংস্কর বিষয়ে যে সকল সুপারিশ ও পরামর্শ আসে, সেই সকল বিষয়ে পুলিশ ইউনিট প্রধানগণ অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং অধস্তন ইউনিট প্রধানদের অবগত করবেন। Judicial Conference এ প্রদত্ত সুপারিশ ও পরামর্শ নিয়মিত প্রতিপালন হচ্ছে কি না তা নিয়মিত তদারকি করবেন।
[শেষ কথা ]
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্ববহন করে। যেকোনো সভ্য দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা একটি সুশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনীর উপর নির্ভর করে। পুলিশ বাহিনী সশস্র আধা-সামরিক বাহিনী হলেও এটি কোনো সমর ক্ষেত্রে হত্যার জন্য প্রশিক্ষিত (Force Trained to Kill During War) কোনো বাহিনী নয়। সাম্প্রতিক সময়ে খবরে প্রায়ই শিরোনাম দেখা যায় যে – “পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত, পুলিশের দাবি মাদক চোরাকারবারি বা ধর্ষণ মামলার আসামি বা ডাকাত দলের সদস্য বা হত্যা মামলার আসামি।”
পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধের খবর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কমিয়ে একেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আস্তে হবে। নতুবা সেই দিন দূরে নয় যেদিন পুলিশের বন্দুজ যুদ্ধের নামে পুলিশ বাহিনী একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বাহিনী দাঁড়িয়ে যাবে যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে। পুলিশ জনগণের বন্ধু এটি এখনো একটি প্রবাদ কিন্তু বাস্তবতা নয়। এখনো সাধারণ মানুষ পুলিশের পরিবর্তে এলাকার রাজনৈতিক নেতার কাছে বিচার নিয়ে যেতে ও সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করে।
করোনা কালে পুলিশ যে ঐতিহাসিক সেবা ও অভাবনীয় ত্যাগ স্বীকার করে জনগণের কাছে নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি স্থাপন করেছে, কেন তা কতিপয় অবাঞ্চিত ও অনিয়ন্ত্রিত পুলিশ সদস্যদের জন্য ভেস্তে যাবে তা আমার বোধগম্য নয়।
লেখক: ব্যারিস্টার মুশফিকুল হুদা