অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ দমন এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তার
দায়িত্বে নিয়োজিত এই বাহিনীর সদস্যরাই সাধারণ মানুষের সব চেয়ে বেশী
কাছাকাছি থাকেন। কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে সাহায্যের আশায় সাধারণ নাগরিকরা
সবার আগে পুলিশেরই দ্বারস্থ হন। সব মিলিয়ে আধুনিক সমাজে পুলিশের ভূমিকা
দৃশ্যমান থাকে বলে পুলিশের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব এবং পুলিশের প্রতি
সাধারণ মানুষের আস্থার বিষয়টিও সর্বদা আলোচিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে
প্রশিক্ষিত ও পেশাদার পুলিশ বাহিনীর প্রয়াজনীয়তা অপরিসীম। দেশের বাস্তবতা
বিবেচনা করলে এ কথা বলা যেতে পারে যে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে
বাংলাদেশ পুলিশ এখন একটি সুসংগঠিত বেসামরিক বাহিনী হিসেবে খুবই কর্মতৎপর।
কিন্তু বাহিনীটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের
কাছে নতিস্বীকার এবং নানারকম দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও
বিস্তর। এক্ষেত্রে জনবল, প্রশিক্ষণ ও সেবার মানোন্নয়নে অবকাঠামোগত
সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অনিয়মকেও উল্লেখ যোগ্য কারণ বলে
মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার
দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে পুলিশ বাহিনীর
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পুলিশ
বাহিনীতে নারী কর্মকর্তা ও নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক
বেড়েছে। এ ছাড়া জরুরী সেবায় সম্প্রতি ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক-এর ৯৯৯ নম্বর
চালু করাও পুলিশি সেবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। দেশে পুলিশের বিভিন্ন
বিশেষায়িত ইউনিট গঠনে সাফল্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে
সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকাও বিশেষভাবে প্রশংসিত
হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে
দুটি উপাদানকে দায়ী মনে করা হয়। একটি হলো, বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষের লেনদেন,
অনৈতিক অর্থ আদায় এবং বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়ম ও
দুর্নীতি। দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক প্রভাব। এসব সংকট কাটিয়ে পুলিশের
পেশাদারিত্ব বাড়াতে লোকবল বৃদ্ধি ও অবকাঠামোর উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে
নিয়ে পুলিশ কে জনসেবায়, তথা পুলিশ জনতা,জনতাই পুলিশ শ্লোগান বাস্তবায়নে
এগিয়ে নিতে হবে বলে জানান বিশ্লেষকরা। সাধারণ মানুষের মন জয়ের পাশাপাশি
পুলিশ সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা দূর করতে পুলিশ কে ঢেলে সাজাতে
করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
এদিকে সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা যায়, ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশকে
নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এজন্য ক্লিন ইমেজের পুলিশ
সদস্যদের বাছাই করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে কক্সবাজারের পাঁচটিসহ চট্টগ্রাম
জেলার একটি থানায় বাছাই করা সদস্যদের ওসি হিসেবে পদায়ন করা হবে।
কক্সবাজার তথা চট্টগ্রাম জেলায়
এতদিন যে ধারার পুলিশিং ব্যবস্থা চালু ছিল গতানুগতিক এ ধারার বাইরে গিয়ে
নতুন ধারার পুলিশিং ব্যবস্থা প্রণয়নের অংশ হিসেবেই নতুন করে ওসি নিয়োগ
দেয়া হচ্ছে। সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন জয়ের পাশাপাশি পুলিশ
সম্পর্কে অত্র এলাকার মানুষের নেতিবাচক ধারণা দূর করবেন নতুন ওসিরা।
৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের
গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনাকে
কেন্দ্র করে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সিনহা হত্যার বিচার দাবির
পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধের জন্য সোচ্চার হয়েছেন দেশের
সর্বস্তরের মানুষ। ইতোমধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে পুলিশের বিরুদ্ধে
একাধিক ভুক্তভোগী মামলা করেছেন। মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান খুনের
ঘটনায় ৫ আগস্ট তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।
এ মামলায় টেকনাফ থানার (বরখাস্ত) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ
এবং ১০ পুলিশসহ ১৩ জন কারাগারে আছেন। মামলার তদন্ত করছে র্যাব। এ ঘটনাকে
কেন্দ্র করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ইমেজ সংকটে পড়েছে পুলিশ।
জানা যায়, কক্সবাজারে ৮টি থানা রয়েছে। এরমধ্যে প্রথমপর্যায়ে কক্সবাজারের
পাঁচটি এবং চট্টগ্রাম জেলার একটি থানায় বাছাইকৃত ক্লিন ইমেজের পুলিশ
সদস্যদের ওসি হিসেবে পদায়ন করা হবে। থানাগুলো হল- টেকনাফ থানা, কক্সবাজার
সদর থানা, উখিয়া থানা, চকরিয়া থানা ও পেকুয়া থানা। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে
রয়েছে পটিয়া থানা। এসব থানার মধ্যে বর্তমানে টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর
থানায় ওসি পদটি শূন্য রয়েছে। উখিয়া থানার ওসি মর্জিনা আক্তারের বিরুদ্ধে
ইতোমধ্যে নানা অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। চকরিয়া
এবং পেকুয়া থানার ওসির বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। এ কারণে এ দুটি থানার ওসি
পদেও পরিবর্তন আসতে পারে। এসব থানায় ক্লিন ইমেজের পুলিশ সদস্যদের ওসি
হিসেবে পদায়ন করার চিন্তা করছেন কক্সবাজার পুলিশ সুপার। তবে প্রথম
পর্যায়ে ওইসব থানায় ওসি হিসেবে পদায়নের জন্য বাছাই করা হয়েছে চট্টগ্রাম
মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চৌকস ছয়জন পুলিশ সদস্যকে। যারা সিএমপিতে
ক্লিন ইমেজের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম রেঞ্জর সাবেক
ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘কক্সবাজারের টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর
থানায় ওসি পদ শূন্য রয়েছে। ওইসব থানায় দক্ষ এবং ভালো ইমেজের পুলিশ
কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’ সিএমপি সূত্র জানায়, পুলিশ
সদর দফতরের প্রথমধাপে বাছাই করা ছয় পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে-ডবলমুরিং
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জহির হোসেন, চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত)
রিয়াজ চৌধুরী, সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া ও
আফতাব, বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি প্রিটন সরকার, সিএমপির গোয়েন্দা শাখার
পরিদর্শক শাহেদুজ্জামানের নাম রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব পুলিশ সদস্যকে ওসি
হিসেবে বিভিন্ন থানায় পদায়ন করা হতে পারে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন
পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (সদর) আমীর জাফর বলেন, ‘পুলিশ সদর দফতর
অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে এ তালিকা করছে। তবে সিএমপি থেকে কার কার নাম উঠে
এসেছে তা আমার জানা নেই।’ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন
বলেন, ‘বর্তমানে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর থানার ওসি পদ
শূন্য রয়েছে। এ দুটি থানায় ওসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
এদদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ কে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি জেলার প্রতিটি
কমিউনিটি পুলিশ তথা জেলা,থানা,ইউনিয়ন সহ সকল কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন
কমিটি দেয়ার ও জোরালো দাবী উঠছে। ইতোমধ্যে কমিউনিটি পুলিশ এর অনেকের
বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশের ভাবমুর্তি নষ্ট করে এক শ্রেনীর কমিউনিটি
পুলিশের নেতা নামধারীরা ব্যাপক চাঁদাবাজি করার অভিযোগ রয়েছে। নানা কারণে
প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে জেলার কমিউনিটি পুলিশ। পুলিশ বাহিনীর বিপন্ন ভাবমূর্তি
পুনরুদ্ধার এবং ‘জনগণের সেবক’ হিসেবে দায়িত্ব পালনে বিরাজমান অসুবিধা দূর
করে তাদের একুশ শতকের প্রত্যাশা অনুযায়ী গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন
বিশ্লেষকরা।